গুরু মহাশয়
.jpg)
কবি জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর 'বনলতা সেন' কবিতা নিয়ে আলোচনা
মোঃ আরিফ হোসেন
কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের একজন অমিত প্রতিভাধর কবি।তাঁর কবিতায় প্রেম, ভালবাসা, বিরহ সবই অপূর্ব মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। কবি সবসময় প্রেমকে জীবনের মূল উপাদান হিসেবে দেখাতে চেয়েছে।কবির বেশির ভাগ কবিতায় প্রকৃতি একটি অনন্য স্থান লাভ করেছে। কবি প্রকৃতিকে অনেক সময় রূপকার্থে ব্যবহার করেছেন। তাঁর কবিতা দুর্বোধ্য কবিতা হিসেবে বাংলা সাহিত্যে স্থান পেলেও শেষ পর্যন্ত এটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হয় এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং একসময় পাঠকের বোধগম্যতার মধ্যে চলে আসে, যদিও কিছু কবিতা এখনও পাঠক সমাজে দুর্বোধ্য হিসেবে স্বীকৃত। বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের পরেই সর্বাধিক পঠিত কবি হিসেবে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর কবিতায় এক ধরনের নেশালো জিনিস জড়িত রয়েছে। কবিতাগুলো পড়লে এক ধরনের ঝোঁকের সৃষ্টি হয়।তাঁর লেখা ' বনলতা সেন ' কবিতাটি সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় কবিতা। তাঁর আরও কিছু কবিতা পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়তার বিচারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। যেমন: আকাশলীনা, আবার আসিব ফিরে, আট বছর আগের একদিন, পেঁচা, অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ, ঘাস, দুজন, হাওয়ার রাত, শঙ্খমালা, পিরামিড,আমি যদি হতাম ইত্যাদি কবিতাগুলো পাঠকের কাছে খুবই সমাদৃত। জীবনানন্দ সারা জীবন জীবনকে আনন্দের মধ্যে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারেননি।তাঁর কবিতায় সে হতাশা স্পষ্ট। তিনি তাঁর আমি কবি সেই কবি কবিতায় বলেছেন, জনম ভর সে কোন হেয়ালি হলনা আমার সাধা পায়ে পায়ে নাচে জিঞ্জির হায় পথে পথে ধায় ধাঁধা। জীবনানন্দের জীবনাবশান ঘটে ট্রাম এক্সিডেন্টে। অনেকেই ধারনা করেন এটি তাঁর ইচ্ছাকৃত জীবন বলিদান ছিল, তিনি হতাশাগ্রস্ত ছিলেন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে ট্রাম এক্সিডেন্টে সঁপে দিয়েছিলেন। যদিও জীবনানন্দের ইহধাম ত্যাগ আত্মহত্যাই ছিল এই সিদ্ধান্তে পুরোপুরি উপনীত হওয়ার মত উপকরণ যথেষ্ট নয়। জীবনানন্দ সারা জীবন প্রেমকে উপসঙ্গ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি দাম্পত্য জীবনে সুখী হতে না পেরে বিভিন্ন নারীর সংস্পর্শকে এক অনন্য আনন্দের ভান্ডর হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যা তার বিভিন্ন কবিতায় পাওয়া যায়। তাঁর কবিতাগুলোতে প্রায়ই বনলতা সেন, শ্যামলী, সবিতা, সুরঞ্জনাসহ বিভিন্ন নাম পাওয়া যায়। জীবনানন্দ মানুষের মাঝে তাঁর আত্মাকে খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। তিনি মানুষকে আনন্দের খোরাক হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের বনতলতা সেন কবিতা নিয়ে আলোচনা :
জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি নিম্নরূপ
বনলতা সেন
জীবনানন্দ দাশ
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে;
অনেক ঘুরেছি আমি;বিম্বিসার অশোকের-ধূসর জগতে;
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য;অতিদূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারাছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভেতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছ সে, 'এতদিন কোথায় ছিলেন?'
পাখির নীড়ের মতন চোখ তুলে, নাটোরের বনলতা সেন।
সমগ্র দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত সন্ধ্যা আসে ;
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে- সব নদী -ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন ;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।
জীবনানন্দ দাশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পঠিত কবিতা হল বনলতা সেন।এই বনলতা সেন নামটি তিনি কোত্থেকে নিয়েছেন তা পরিষ্কার হওয়া যায়না।তবে বনলতা সেন কবিতায় তিনি বনলতা সেন বলতে কোন নারীকে বুঝিয়েছেন এটা নিশ্চিত নয়।কেউ কেউ বনলতা সেন বলতে মৃত্যুচিন্তা, কেউ কেউ তাঁর প্রেমের নির্দেশিত নারী, কেউ এই জগত সংসারকে বুঝিয়েছেন। জগতসংসার বলতে এটাই বোঝায় মানুষের এ জগতে আসা এবং তার প্রেমে পড়া।মানুষের পৃথিবীতে আসার পর যা ঘটে সবই জগতসংসারকে ঘিরে হয়।তাঁর যখন মৃত্যু ঘটে তখনও তিনি জগত নিয়ে ভাবেন এবং এ জগতে তিনি কি রেখে গেলেন এবং পরজগতে তা তার কতটা সহায় সম্বল হবে সেটাই তার ভাবনা থাকে। যারা তাঁর এ কবিতার বিষয়বস্তু জগতসংসার ভাবেন আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত। কবি প্রথম দিকেই বলেছেন, আমি ক্লান্ত প্রাণ এক। অর্থাৎ তিনি চলতে চলতে ক্লান্ত, তিনি নতুন কিছু চান।এই নতুন কিছু হল বনলতা সেন।অর্থাৎ তিনি যখন ক্লাস তখন বনলতা সেন তাঁকে শান্তির ছায়া দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি যে বেছে আছেন এটাই তাঁর শান্তির ছায়া।দ্বিতীয় স্তবকে তিনি বলেছেন, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা..........। অর্থাৎ এই পৃথিবীর মায়াকে তিনি অন্ধকার বিদিশার নিশা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দ্বিতীয় স্তবকের শেষ লাইনে তিনি বলেছেন, বনলতা সেন তাঁকে বলেছে, এতদিন কোথায় ছিলেন? অর্থাৎ এই পৃথিবীতে যে তিনি বেঁচে আছেন এটাই তাঁর বাঁচার জন্য যথেষ্ট। শেষ স্তবকে তিনি বলেছেন, সমগ্র দিনের শেষে শিশিরের সন্ধ্যার মত সন্ধ্যা আসে। অর্থাৎ মৃত্যু আসে। শেষে তিনি বলেছেন, সব পাখি ঘরে আসে সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সবলেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।অর্থাৎ অন্ধকারে তিনি হারিয়ে যাবেন এবং অন্ধকারকে অবলম্বন করে তিনি বেঁচে থাকবেন এটাই তাঁর সান্ত্বনা।এক কথায় এই কবিতায় তিনি জীবনের চাওয়া পাওয়াকে গুরুত্ব দিয়েছেন। যা চেয়েছেন যা পেয়েছেন এটাই তাঁর চাওয়া বা স্বস্তি।
আপনার মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা
ReplyDelete